নাইরোবিতে প্রত্যাবর্তন

ফিরে এলাম নাইরোবিতে। ফিরেই গঙ্গাভাই এবং জিমকে জানালাম সবকিছু বিস্তারিতভাবে। সাথে এটাও জানিয়ে দিলাম প্রথম পরিচয়টা হবে হারারেতে। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম কেনও এই সাক্ষাত ঢাকায় না হয়ে হবে হারারেতে। এরপর শঙ্কা এবং খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করে অভিযোগ জানালেন আপনি ঢাকা ঘুরে গেলেন আমার সাথে সালাম দোয়া না করেই!

তার এমন খোঁচায় কিছুটা চমকে উঠলাম! বেগম জিয়া কি তবে জনাব মুস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্বাস করে সবকিছুই বলে দিয়েছেন!

যদি তেমনটি করে থাকেন তবে সব পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যে সাউথ ব্লকে পৌঁছে গিয়ে থাকবে। ফলে আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই সুবর্ণ সুযোগ হারালে অপূরণীয় ক্ষতি হবে দেশ ও জাতির। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কি ক্ষতি হবে সেটা মুখ্য বিষয় নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনের পর উল্টো বাতাস বইতে শুরু করল।
দেখলাম, মওদুদের মতো বাস্তুঘুঘুরা, যারা শহীদ জিয়ার রক্ত মাড়িয়ে জেনারেল এরশাদের ছত্রছায়ায় গিয়ে ভিড়েছিল তারা আবার অক্লেশে খালেদার আঁচলের নিচে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিতে পারল অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানদের মতো ক্ষমতাশালী পার্টি নেতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে।

ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্‌-এর মধ্যস্থতায় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেনারেল জিয়ার আমলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কাদের সিদ্দিকি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ সন্ত্রাসীদেরকেও ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হল। শুধু কি তাই? কাদের সিদ্দিকিকে একটি দৈনিক প্রকাশনার লাইসেন্স এবং একটি অত্যাধুনিক প্রেস স্থাপনের জন্য মোটা অংকের অনুদানের বন্দোবস্ত ব্যাংক থেকে করে দেয়া হলো সরকারের তরফ থেকে। অন্যদিকে জনাব গোলাম আজমকে জামায়াতের আমীর বানিয়ে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য জোটের শরিক দল জামায়াত খালেদা জিয়ার উপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে চলল। খালেদা জিয়া জামায়াতকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, সরকারি হুকুমে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে না দিয়ে কাজটি আদালতের মাধ্যমে করাটাই হবে শ্রেয়। তার এ ধরনের অভিমত জামায়াতের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। জামায়াত নেতৃত্ব মনে করলো খালেদা জিয়া নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার পর তার ওয়াদার বরখেলাপ করছেন। শুরু হলো বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে টানাপড়েন। এই সুযোগ গ্রহণ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে চাণক্যপুরির কর্ণধারদের এবং হাসিনার ইশারা এবং সমর্থনে হঠাৎ করেই বেগম জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গজিয়ে উঠল ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ যুগ্ম আহবায়ক হিসাবে তাতে যোগদান করলেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কাজি নুরুজ্জামান বীরউত্তম। তাদের দুই জনই ছিলেন শিখণ্ডি মাত্র। এর পেছনে মুখ্য খেলোয়াড়রা ছিলেন শাহরিয়ার কবির, সি আর দত্ত (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিষদের কর্ণধার), কর্নেল ওসমান, কর্নেল শওকত আলী, মুনতাসীর মামুন, হাসান ইমাম, লেখক শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, নীলিমা ইব্রাহিম, কামাল লোহানী, নাসিরুদ্দিন বাচ্চু, এমআর আখতার মুকুল, সুফিয়া কামাল, এবিএম মুসা, আসাদ্দুজ্জামান নূর, কবির চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, গফফার চৌধুরী, তুহিন আফরোজ, নির্মলেন্দু গুণ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ। তারা প্রকাশ্যে গণআদালত গঠন করে জনাব গোলাম আজমের বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত করে তার কুশপুত্তলিকার ফাঁসির নাটক মঞ্চস্থ করে। এই ঘটনার পর আস্থার এবং বিশ্বাসের অভাবে বিএনপি-জামায়াত আঁতাত ভেঙ্গে যায়। সময় বুঝে টোপ ফেলে আওয়ামীলীগ আর সেই টোপ গলাধঃকরণ করে জামায়াত চরম সুবিধাবাদিতার প্রমাণ দেয়। হাসিনাসহ আওয়ামীলীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, জামায়াত ‘নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন’ এবং আওয়ামী লীগ ‘সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইস্যু নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে এবং সংসদের বাইরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে সরকার পতনের লক্ষে। সাথে থাকবে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি।

এই সমঝোতা পচনশীল সমাজের নীতি-আদর্শ বিবর্জিত অপরাজনীতির এক কদর্য হিঃপ্রকাশ। এই আঁতাতের পর হঠাৎ করেই ভাঁটা পড়ে ‘ঘা দা নির্মূল কমিটি’-এর কর্মতৎপরতায়। দেরিতে হলেও জাহানারা ইমাম এবং কর্নেল নুরুজ্জামান বুঝতে পারেন রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের ব্যবহার করেছে মাত্র।এই মনোকষ্ট নিয়ে ক্যন্সার আক্রান্ত জাহানারা ইমাম যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছেলের কাছে পাড়ি জমান এবং সেখানে ক্যান্সার অপারেশনের পর মারা যান। কর্নেল নুরুজ্জামান নিজের ভুল বুঝে চিরতরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অব্যহতি গ্রহণ করেন। এরপরের ঘটনা আরও হতাশাব্যঞ্জক। ভারতপন্থীদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান খালেদা জিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বোঝালেন যে সেনা পরিষদের নেতাদের বিশেষ করে আমার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা নাকি তার জন্য কাল হয়ে দাড়াবে। এক সময় আমি নাকি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে ১৫ আগস্টের স্বীকৃতি আদায় করে নেবো এবং আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে জেনারেল জিয়া প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সেটাও বিশ্বপরিসরে প্রমাণ করিয়ে ছাড়বো! ফলে প্রতিবেশী ভারতের রোষানলে পড়ে তার সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাড়াবে!

কিছু সমমনা আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পার্টিনেতা একই সুরে ঐক্যতান তুলে খালেদাকে নসিহত করেছিলেন প্রয়াত শহীদ জিয়ার ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর-এর ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সাথে কোনও প্রকার সম্পৃক্ততা ছিল না সেটা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। এরপর থেকে তারই নির্দেশে বিএনপির পার্টি পজিশন হচ্ছে, জেনারেল জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন সেনাবাহিনী এবং দেশবাসীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণেই। এই ভিত্তিতে মুজিবের পতনের কোনও দায়দায়িত্ব না নিয়েই তিনি ১৯ দফার রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঠিক একই ভাবে তিনি প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতের সাথেও সমঝোতা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে যে, ‘মুজিব হত্যার’ সাথে তার কোনও সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না। আর সেটার প্রমাণ স্বরূপ তিনি শেখ হাসিনাকে ভারতের নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সহ-অবস্থানের রাজনীতি করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সেই ক্ষেত্রে আমাদের সাথে খালেদা জিয়ার যেকোনো সম্পর্ক তার প্রয়াত স্বামীর প্রণীত রাজনীতিকেই বিপন্ন করে তুলবে। শুধু তাই নয়, এখন যদি খালেদা জিয়া তার স্বামীর রাজনৈতিক সমীকরণ এবং পররাষ্ট্র নীতিতে কোনও পরিবর্তন আনতে চান তাহলে তার সরকারই অচল হয়ে পড়বে এবং তার নিজের জীবনও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভারতের রোষের কারণে। অতএব সর্ব বিবেচনায় এখন থেকে সেনা পরিষদ, আগস্ট বিপ্লবী কিংবা বিপ্লবের নেতাদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে না। ভারতের পোষা এই দালালগোষ্ঠী কিন্তু তাদের উপস্থাপনার সময় অতি প্রাসঙ্গিক প্রণিধানযোগ্য বিষয়গুলো কৌশলে এড়িয়ে গেলেন! ভারতের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে হাসিনাকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনার মাত্র ১৩/১৪ দিনের মাথায় এক ষড়যন্ত্রে জেনারেল জিয়াকে অপমৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এটাও জ্ঞানপাপীরা বললেন না যে, ভারতের চিরলালিত স্বপ্ন হলো নিজেকে বিশ্বের একটি পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে এই উপমহাদেশে তার একছত্র আধিপত্য কায়েম করা।

ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির দর্শন ‘নেহেরু ডকট্রিন’ অনুযায়ী ‘অখণ্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সাউথ ব্লকের কুশিলবরা এবং ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার ভারত বিভক্তির পর থেকেই। ব্রিটিশদের সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ যতদিন টিকে থাকবে ততদিন ভারতের শাসকগোষ্ঠী তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াস থেকে এক চুলও নড়বে না প্রতিবেশী দেশগুলো যতই ছাড় দিক না কেনও। কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, গোয়া, দমন, দিউ এবং সিকিমকে অস্ত্রবলে গিলে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা এবং স্বাধীনতাকামী রাজ্যগুলোকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনস্থ করে আজঅব্দি অস্ত্রবলে দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়া এই বাস্তবতাকেই প্রমাণিত করে।

সুতরাং যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা চলে, যতদিন না কৃত্রিমভাবে বিদেশী আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর স্বার্থে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে অস্ত্রের জোরে তাদের স্বাধীনতা এবং আবাসভূমি ছিনিয়ে নিয়ে সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’-এর বিলুপ্তি না ঘটবে ততদিন এই অঞ্চলে স্থায়ী স্থিতিশীলতা কখনোই কায়েম হবে না। যার ফলে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নও কখনোই সম্ভব হবে না। যেহেতু স্থিতিশীলতা আর্থ-সামাজিক উন্নতির একটি আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত কখনোই একটি দেশ ছিল না যার প্রমাণ ব্রিটিশদের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই স্বাধীন হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের হারানো স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র নরুদ্ধারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে আজঅব্দি লিপ্ত রয়েছে। এ সমস্ত সংগ্রাম ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অঞ্চলে কেন্দ্র কর্তৃক কঠোর সামরিক শাসন, অভিযান এবং নির্মম পাশবিক অত্যাচার, জুলুম ও নিষ্পেষণের মুখেও। কোনও জাতির স্বাধীনতার জন্য রক্তের আহূতি বৃথা যায় না। স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রলম্বিত হতে পারে, সাময়িকভাবে পশুশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করা যায়, কিন্তু স্বাধীনতার চেতনাকে পরাজিত করা কখনোই সম্ভব হয় না।

অধুনাকালে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। মানুষ স্বাধীনভাবেই জন্ম নেয়, তাই স্বাধীনভাবে বাঁচা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। এই প্রাকৃতিক বিধানকে বর্তমান উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন মেনে চলেছে এবং অন্যান্য শক্তিগুলোকেও মেনে নিতে হবে তাদেরই স্বার্থে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই। বিধাতার এই নিয়মটিকে মেনে না নিলে বিশ্বের বর্তমান সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে অচিরেই অতীতের অনেক সভ্যতার মতোই।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অপরিপক্বতা, অদূরদর্শী ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে জিমের আমন্ত্রণপত্র এবং আমার হারারে যাবার নির্দেশ এলো না। পরিণামে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে বিকশিত করার জন্য ভারতের চাপের মুখে ভারসাম্যতা বজায় রাখার প্রয়োজনে অত্যাবশ্যকীয় স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে গেলো।

দুর্ভাগা দেশ ও জাতির অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলাম। জিমকে ফোন করে সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বলেছিলাম জিম, আমাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেলো! জবাবে জিম বলেছিলো ভালোই তো হয়েছে, শুরুতেই আমরা খালেদা জিয়ার যোগ্যতা এবং চরিত্রটা বুঝে নিতে পারলাম। দুঃখ পাচ্ছ কেনও? খালেদা কিংবা হাসিনা তো অবিনশ্বর নয়, তারাও একদিন দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু থেকে যাবে বাংলাদেশ।

তবে একটি কথা তোমার জ্ঞাতার্থে বলছি, নেতা-নেত্রীদের চারিত্রিক গুণাবলী, দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতা যেকোনো দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী কিংবা পশ্চাদপদতার জন্য মূলত দায়ী হয়ে থাকে।

কিছুদিন পর জানতে পারলাম, মিলিয়ন ডলার খরচ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে বসবাসকারী তার ভাগ্নের মাধ্যমে আমেরিকাতে RAW-এর বিশিষ্ট এজেন্ট ‘কাঞ্জু’ নামে পরিচিত এক ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীর সহযোগিতায় খালেদা জিয়ার জন্য আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আয়োজিত বাৎসরিক ‘ব্রেকফাস্ট প্রেয়ার’ অনুষ্ঠানে যোগদানের নিমন্ত্রণ জোগাড় করেছিলেন।

প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিশ্বের প্রায় শ’খানেক রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধান এবং বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ থেকে বাছাই করে নিমন্ত্রণ করা হয়। প্রেয়ার শেষে প্রাতঃরাশের পর প্রত্যেকের সাথে প্রেসিডেন্টের একটা সৌজন্যমূলক ফটো সেশনের শেষে অভ্যাগতদের বিদায় জানানো হয়। প্রথা অনুযায়ী এই মিলনমেলায় ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য শক্তিধর ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন না। এই সফরকালে বেগম খালেদা জিয়াকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারি। মোটা অংক খরচ করে ওয়াশিংটন পোস্টে তার সফর সংক্রান্ত কয়েক লাইনের একটা খবর ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশের দূতাবাস।

দেশে ফেরার আগে খালেদা জিয়া তার হোটেলে এক প্রাতঃরাশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন বন্ধুদের। তার সেই নিমন্ত্রণে সাড়া দেননি কেউই। মনোকষ্ট আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। খবরটা জিমই আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলো। নিয়তির পরিহাস!

চক্রান্তকারী ভারতীয় দালালদের প্রভাবে বিরল সুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক-বাহকের দাবিদার দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া! এরপর আমি আমার গতানুগতিক রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বই পালন করে চলেছিলাম। ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন হিসেবে অনান্য রাষ্ট্রদূতদের তুলনায় আমাকে ব্যতিক্রমী বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে কিছুটা বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। একই সাথেপর্যবেক্ষণ করছিলাম জাতীয় শত্রুদের সাথে আপোষের রাজনীতির তামাশা।

সমঝোতা মোতাবেক পরিকল্পিতভাবে আওয়ামীলীগ, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির ঐক্যবদ্ধ খালেদা সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রতিদিন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। একই সাথে ‘হাওয়া ভবন’ কেন্দ্রিক তারেক জিয়ার দাম্ভিক আচরণ, দুর্নীতি ও সরকারি এবং দলীয় সিদ্ধান্তে ‘হাওয়া ভবনের’ অযাচিত হস্তক্ষেপ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল খালেদা জিয়াকে কোণঠাসা অবস্থায় অসহায় করে তোলে।

এই অবস্থায় পরিবারতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে আচমকা তারেক জিয়াকে দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের মাথা ডিঙ্গিয়ে পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জ্বলন্ত লাভায় ঘি ঢাললেন খালেদা জিয়া। শুরু হলো মনকষাকষি এবং দলীয় কার্যক্রমের প্রতি ত্যাগী নেতাদের অনীহা। এর প্রভাব পড়লো কর্মীদের মধ্যেও।

নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তারাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। অন্যদিকে ‘হাওয়া ভবন’থেকে তারেক জিয়া কর্তৃক সরকারি এবং পার্টি সিদ্ধান্তে কলকাঠি নাড়ার ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় অরাজকতা। এই অসহায় অবস্থায় মিত্রহীন খালেদা উপায়হীন হয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার জায়গায় সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আওয়ামীলীগের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু কেয়ার টেকার গভর্নমেন্ট-এর অধীনে নির্বাচনের দাবিটি মানতে রাজি না হওয়ায় তার সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন আরও দুর্বার করে তোলে আওয়ামী-জামায়াত জোট। সেই বেসামাল অবস্থায় ঘরের শত্রুরাও বিভীষণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তার সুপুত্র তারেক জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ এবং ‘হাওয়া ভবনের’ চামচারা, কোকো, সাঈদ ইস্কান্দার, চকলেট আপা শহীদ জিয়ার গর্ব ‘ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জির’ কাহিনীকে বিসর্জন দিয়ে জড়িত হয়ে পড়ে অবাধ দুর্নীতিতে। দুর্নীতির মাধ্যমে জিয়া পরিবার রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠে, খালেদা জিয়া উটপাখির মতো বালির ঢিবিতে মাথা গুঁজে সব দেখেও না দেখার ভান করে মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ থাকেন।

বয়স বেড়ে চলেছে, কিন্তু সেই অনুপাতে শিফন শাড়ির বাহার, দামি অলংকার আর পরচুলার চাকচিক্য কমার পরিবর্তে বরং মাত্রাহীন ভাবে বেড়ে চলেছে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের ব্যর্থতায় জনসমর্থনও দ্রুত কমতে থাকে। সময়ের সাথে যতই খালেদা সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছিল ততোই আওয়ামী জোট তাদের চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে সংসদে এবং রাজপথে।

এমতাবস্থায় সরকারের মেয়াদ শেষে তিনি বিগত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের মতোই নির্বাচনের ঘোষণা দেন দলীয় সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী জোট, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি।ফলে নির্বাচন এক প্রহসনে পরিণত হয়। এই ধরনের অপরিপক্ব হঠকারী পদক্ষেপের পর খালেদা জিয়ার অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। শেষরক্ষার জন্য নিরুপায় খালেদা জিয়ার সরকার জাময়াতের ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি মেনে নিয়ে এর জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনী সংসদে পাশ করিয়ে তার দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সংসদ বিলুপ্ত করে দেন। রাষ্ট্রপতি একটি ‘কেয়ার টেকার’ সরকার মনোনীত করেন। তাতে খুশি হতে পারেনি আওয়ামী জোট এবং তাদের দোসররা। সেই জন্য হাসিনা ও তার প্রভু ভারতের ইঙ্গিতে তৎকালীন সাঈদ ইস্কান্দারের পরামর্শে খালেদা জিয়ার নিয়োজিত সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টেকে উৎখাতের জন্য একটা সামরিক ক্যু’দাতা ঘটানোর চেষ্টা চালানো হয়। নড়বড়ে সরকারের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে জেনারেল নাসিমের ক্যু সফল হবে সেটা অবধারিত মনে করে হাসিনা প্রকাশ্যে জেনারেল নাসিমের ক্যু’দেতাকে সমর্থন জানান যেমনটি জানিয়েছিলেন বেআইনী ভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ যখন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বন্দুকের জোরে পদত্যাগে বাধ্য করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করে নেন। জনাব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে মুল ক্রিয়ানক ছিল ভারত সমর্থিত জেনারেল নাসিম আর্মি চিফ, জেনারেল হেলাল মোরশেদ, ব্রিগেডিয়ার মিরণ এবং জেনারেল ইব্রাহিম বীর প্রতিক।

কিন্তু কয়েকজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী কমান্ডারদের প্রতিরোধের মুখে নাসিমের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কমান্ডারদের মধ্যে জেনারেল ইমামুজ্জামান, জেনারেল ভুঁইয়া, জেনারেল মাহবুব এবং জেনারেল মতিনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে একজন নির্দলীয় ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি তথাকথিত ‘কেয়ার টেকার’ সরকার গঠিত হয় আওয়ামী জোট, তাদের দোসর জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির গ্রহণযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে।

অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে কোনও দলের পক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সম্ভব হয়নি। খালেদা জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে সরকার গঠন করার জন্য সব নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তার স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের করুণ মৃত্যুর পেছনে ধূর্ত চক্রান্তকারী স্বৈরশাসক এবং ভারতের পোষ্যপুত্র জেনারেল এরশাদের সমর্থন আদায় করার জন্য তাকে প্রধান মন্ত্রীর পদ দেবার অঙ্গীকার করে অনেক আকুতি মিনতি করেও ব্যর্থ হন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা পক্ষান্তরে খালেদার আদিখ্যেতা দেখে ক্রূর হাসি হেসে জামায়াত এবং এরশাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। এই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল ১১৬ টি আসন লাভ করে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসন অলংকৃত করে। জামায়াতের সিটের সংখ্যা ১৮ থেকে কমে এলেও আওয়ামী লীগের কৃপায় জনাব গোলাম আজমের নাগরিকত্ব লাভ করতে জামায়েত ইসলামী সমর্থ হয়। এরশাদ জেল থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হন। ব্যর্থ ক্যু’দাতার শিরোমণি জেনারেল নাসিম এবং তার দোসরদের কোর্টমার্শালে প্রাপ্ত সাজা মওকুফ করে দেয় শেখ হাসিনা সরকার। শুধু তাই নয়, তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্তের কোর্টের রায় বাতিল করে তাদের সৌজন্যে অবসর প্রদানের আদশ জারি করা হয় যাতে পেনশনসহ অন্যান্য সব সুবিধাই তারা উপভোগ করতে পারেন।

ফিরে যাই ১৯৯৬- এর নির্বাচনের পূর্বে নাইরোবিতে থাকাকালিন অবস্থায় আমার চাকুরি জীবনে আর একবার যবনিকাপাত কি করে ঘটেছিলো সেই পর্বে। ১৯৯৩ সালে চাচা, খালাম্মাকে সাথে নিয়ে যুগলে ফরজ হজ্ব করে নাইরোবিতে ফেরার পর অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে এক দুর্ঘটনা! একদিন প্রত্যুষে ফজরের আযানের পর অজু করার জন্য বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে নিম্মির স্লিপডিস্ক হওয়ায় ও চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। পড়ে যাবার পর নিম্মি একদম নড়াচড়া করতে পারছিলো না, শুধু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। জরুরী ভিত্তিতে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে তাকে নাইরোবি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা জানালেন, লোয়ার লাম্বারে একটা ডিস্ক কলাপ্স করেছে বাজে ভাবে ডিজেনারেটেড অবস্থায়। হতবাক হয়ে গেলাম। নিম্মি বরাবর তার খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চার বিষয় খুবই সচেতন!

প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে সারা পাকিস্তান ব্যাপী কথক নাচে ও সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলো কলেজে পড়ুয়া ছাত্রী অবস্থায়। সেই নিম্মিকেই হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসার অধীনে ঘাড়ে-কোমরে-পায়ে ট্র্যাকশন নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী করে রাখা হয়েছিলো দীর্ঘ দেড় মাস। দেড় মাস পর নিম্মি লাঠির উপর ভর দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় অতি কষ্টে। ঐ অবস্থাতেই তার ইচ্ছায় বাসায় নিয়ে আসলাম। চিকিৎসা চলতে থাকলো। বাসায় নিয়মিত আসছে ডাক্তার এবং ফিজিওথেরাপিস্ট। নিম্মির অসুস্থতার সংবাদ জানা মাত্রই নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাই ছুটে এলো নাইরোবিতে।
স্বপন ও কেয়া দু’জনেরই ব্যাক প্রবলেম ছিলো। দু’জনই প্রায় পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময় তাদের এক বন্ধুর পরামর্শে দুইজনই সিঙ্গাপুরের একজন বিখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন ডঃ ফ্রেডি চু-এর কাছে যায়। তিনি তাদের পরিষ্কার বলেন স্পাইন এর অপারেশন-এ সাফল্যের সম্ভাবনা কম। তাই তিনি অপারেশনের পক্ষে নন। তবে তারা রাজি থাকলে তিনি চৈনিক ট্র্যাডিশনাল পন্থায় তাদের চিকিৎসাকরতে পারেন। তারা রাজি হওয়ায় তিনি চিকিৎসা করেন এবং দু’জনই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। কেয়া ও স্বপনের জোরাজুরিতেই নিম্মিকে ডঃ ফ্রেডি চু-এর কাছে নিয়ে গেলাম। স্বপনই সব ব্যবস্থা করে দিল। নিম্মিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডঃ ফ্রেডি চু বললেন, নিম্মির কেসটা কেয়া এবং স্বপনের চেয়ে জটিল বিধায় প্রতি তিনমাস অন্তর তাকে সিঙ্গাপুর আসতে হবে দুই সপ্তাহের জন্য। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যে মেরুদণ্ডে ইনজেকশনের সাথে কিছু বিশেষ ফিজিওথেরাপিও গ্রহণ করতে হবে অভিজ্ঞ চৈনিক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে। এভাবেই চিকিৎসাচলবে এক বছর। এরপর অবস্থার উন্নতি দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুরু হলো চিকিৎসা। সময়ের সাথে অভূতপূর্ব উন্নতি পরিলক্ষিত হলো আল্লাহ্‌র রহমতে। এক বছরের মধ্যেই নিম্মি অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠলো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ ফ্রেডি চু ঠিক করলেন দ্বিতীয় বছর তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাস অন্তর সিঙ্গাপুরে আসার। দ্বিতীয় বছরের শুরুতেই নিম্মি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠল, চার্ট মোতাবেক ব্যায়াম করছে, হাঁটছে নিয়মিতো, ফলো করছে ডায়েট চার্ট। কিন্তু হাতে ছড়িটা রাখতে হচ্ছে কোনও প্রকার দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য।

সেই সন্ধিক্ষণে নাইরোবিতে আমার টেনিওর প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো। তাই পোস্টিং অর্ডার আসার আগেই আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আবেদন জানালাম, মানবিক কারণে নিম্মির চিকিৎসার সুবিধার্থে আমাকে যাতে সিঙ্গাপুর কিংবা তার নিকটবর্তী কোনও দেশে পোস্টিং দেয়া হয়। সেই আবেদনের জবাবে পেলাম পোস্টিং অর্ডার সুদূর ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত হিসাবে। এই পোস্টিং অর্ডার পেয়ে কিছুটা হতবাক হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আর একটি চিঠি লিখে পাঠালাম। তাতে জানালাম, সুদুর ব্রাজিল থেকে সিঙ্গাপুরে নিম্মির চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়সাপেক্ষ। সার্বিক বিবেচনায় তিনি যাতে আমার পোস্টিং অর্ডারটা পুনর্বিবেচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জবাব এলো। আমাকে জানানো হল, আদেশ অমান্য করার জন্য সরকার আমাকে চাকুরি থেকে অবসরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমার রিপ্লেসমেন্ট পাঠানো হচ্ছে, তার কাছে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে আমি যাতে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে অবসর গ্রহণ করি। জবাব পাওয়ার দুই-তিনদিনের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন আমার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা জনাব মোমেন। সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তার কাছে চার্জ বুঝিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছরের কূটনৈতিক জীবনের ইতি ঘটল কিছুটা অস্বাভাবিক ভাবেই।
১১ই এপ্রিল ১৯৯৫ সালে আমার স্থলাভিষিক্ত হলেন নবাগত রাষ্ট্রদূত। আচমকা এ ধরনের সরকারি সিদ্ধান্তে অস্বস্তিকর অবস্থায় নিজেরাও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম।

সেই সন্ধিক্ষণে দেবদূতের মতই পাশে এসে দাড়াল বিশ্বস্ত পরম বন্ধু রব্বানি খান। আমাকে হতোদ্যম হতে না দিয়ে বললো চাকুরিচ্যুতি এবং চাকুরি ছাড়ার ঘটনা তোমার বর্ণিল জীবনে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সাক্ষাৎমৃত্যুর হাত থেকেও পাঁচবার বেঁচে গেছো তুমি। এ সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক তোমাকে তার অসীম করুণায় এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছেন অতীতে, ভবিষ্যতেও অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করার জন্য তার রহমত তোমার উপর থাকবে এবং তিনিই ভবিষ্যতে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন ইন শা আল্লাহ্‌ এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুমি অবিচল হয়ে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে যাও সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। রাব্বুল আলামিন সব কিছুই জানেন এবং দেখছেন। তুমি যেভাবে ইমানের সাথে তার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে তারই সৃষ্ট বিশ্বমানবতা এবং নিপীড়িত মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে জাগতিক সব প্রলোভন উপেক্ষা করে একমাত্র তাকেই খুশি করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ নিয়ে তার রহমতের উপর ভরসা করে বহু দুর্গম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলেছো, তাতে তিনি নিশ্চয়ই তোমার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য পুরস্কৃত করবেন এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সব অন্যায়-অবিচারের বিচার তিনি অবশ্যই করবেন।

অদ্ভুত আমার বন্ধু এই রব্বানি খান! কোহিনূরের চেয়েও দুর্লভ এক হীরের টুকরো। আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। জাগতিক মানদণ্ডে একজন ঈর্ষণীয় ধন ও যশের অধিকারী হয়েও অন্তরে একজন সাধক ফকির। উম্মতে মোহাম্মদ(সাঃ) রব্বানি খান জাগতিক জীবনের সব দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে দৃঢ় ইমানের ভিত্তিতে আন্তরিক একাগ্রতার সাথে আল্লাহ্‌তায়ালার নৈকট্য পাবার জন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে কঠোর সাধনা করে চলেছে। তার উদার আর অতি স্বচ্ছ মনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বারবার অভিভূত করেছে তার নৈকট্যে আসার পর থেকেই। এ জগতের মানুষ হয়েও রব্বানি যেন অদৃশ্যলোকের কেউ ! বিভিন্ন ঘটনায় তেমনটিই মনে হয়েছে আমার। হটাৎ করেই বছর তিনেক হল পরম একান্ত প্রিয় বন্ধু এবং সাথী রব্বানি কিছুটা আকস্মিকভাবেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে ফিরে গেছে না ফেরার দেশে। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফিরদউসে স্থান দিন সেই দোয়াই করে চলেছি।