দ্বিজাতি তত্ত্ব

স্বাধীনতার পরপরই ভারতীয় সরকার এবং তাদের আঁতেলরা জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে শুরু করলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ যার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান নামের দুইটি রাষ্ট্রে ‘ভারত মাতা’ বিভক্ত হয়েছিল সেই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

গান্ধী, নেহেরু, গোখেল, প্যাটেল প্রমুখ কট্টর বর্ণহিন্দু নেতাদের খায়েশ ছিল ব্রিটিশ রাজ থেকে কোনোমতে ছলেবলে কৌশলে হিন্দুস্তান নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাগিয়ে নিয়ে পুরো উপমহাদেশটাকেই গিলে খেতে এবং পরবর্তীতে ভারতমাতার পুনর্জন্ম ঘটাতে। কিন্তু তাদের সেই গুড়ে পড়লো বালি।

উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলো। কিন্তু অন্যান্য জাতিসত্তার তুলনায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ-হিন্দু নেতাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের বাধ্য করে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে। তুলনামূলকভাবে দুর্বল অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্রের জোরে দাবিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলো ভারতের আগ্রাসী চাণক্যরা ব্রিটিশদের সহায়তায়। কিন্তু এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেই সময় থেকেই এখনঅব্দি স্বাধীনতার সংগ্রাম চলে আসছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভারতীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। ক্রমান্বয়ে এই সব জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাদের সংগ্রামী চেতনাকে শাণিত করেছে। যদিও স্বদেশী কিছু ভারতীয় তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল, তাদের পোষা নেতানেত্রী এবং উচ্ছিষ্টভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বীণার সুরে একই তান শুনে বোঝা যায় ওরা কি জাতের প্রাণী! তাদের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দ্বিজাতি তত্ত্বের সঠিকতাই শুধু প্রমাণ করেছে তাই নয়, এই স্বাধীনতা এটাও প্রমাণ করেছে যে ভারতীয় ইউনিয়ন ব্রিটিশ সৃষ্ট একটি অবাস্তবতা যা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সাল থেকেই একই প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে কৃত্রিম এই ভারতীয় ইউনিয়ন।

ইতিহাসের নিরিখে উপমহাদেশ বহুরাষ্ট্রিক একটি ভূখণ্ড। ঐতিহাসিক সীমানাগুলো বলপূর্বক সাময়িকভাবে বিকৃত করে দেয়া হলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই একসময় রাষ্ট্রগুলোর প্রকৃত সীমানা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক বিধানে। স্বাধীন সত্তার ঐতিহ্য বহনকারী জাতিগুলো চিরকাল চাণক্যদের অধীনস্থ হয়ে থাকবে না। বিজাতীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোই তাদের শাসন ও শোষণের স্বার্থে অস্ত্রবলে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই উপমহাদেশে একটি একক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলো। বৈদিকযুগের আর্যভাষীদের আগমনের কাল থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল পর্যন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে এই সত্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। বৈদিক কালের যাযাবর বর্ণহিন্দুরা পামির মালভূমি থেকে নেমে এসে উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চলে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে ‘অখণ্ড ভারত’ কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি শক, হুন, আফগান, পারসি, পাঠান, মুঘল, আক্রমণকারী শাসকরাও।

একমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই উচ্চতর মানের সমর সম্ভার এবং বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বদৌলতে পুরো উপমহাদেশকে একটি প্রশাসনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলো। অতএব, যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলা যায়, একক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতীয় ইউনিয়নের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক এবং কৃত্রিম। এখানে একটি সত্য প্রণিধানযোগ্য।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের আগপর্যন্ত কোন বিদেশী শক্তির পক্ষেই সম্ভব হয়নি বাংলাদেশকে পরাধীন করা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান রবার্ট ক্লাইভ এসে বাংলাদেশের উপকূলে নোঙ্গর ফেলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উছিলায়। বাংলাদেশ তৎকালিন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। ব্যবসায়িক সূত্রেই ক্লাইভের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে এতদঞ্চলের হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং বেনিয়া সম্প্রদায়ের। এই সখ্যতার ধারাবাহিকতায় শিখন্ডি মীরজাফরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বাংলার নওয়াব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে মুসলিম বিরোধী এক গভীর ষড়যন্ত্র। এই প্রেক্ষাপটেই সংঘটিত হয়েছিলো পলাশীর যুদ্ধ। সেই প্রহসনের যুদ্ধে উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, ঘসেটি বেগম এবং হিন্দু বেনিয়াদের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত হন বিশাল বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা।

বাংলাদেশ কব্জা করে নেয় ব্রিটিশ রাজ। এরপর পুরো ভারতবর্ষকেই ব্রিটিশ আগ্রাসীশক্তি উপনিবেশে পরিণত করে দিল্লীর শেষসম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে। এই পরাজয়ের পিছনেও রয়েছে মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষী হিন্দু রাজা-মহারাজা এবং ধনী বেনিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতার এক করুণ উপাখ্যান।

উনিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আন্দোলন যখন শৌর্যবীর্যে তেজঃদীপ্ত হয়ে দানা বেঁধে উঠছিলো তখনই পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত বর্ণহিন্দুদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষে অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম এবং অ্যানি বেসান্ত-এর উদ্যোগে জন্ম হয় পরিকল্পনা অনুযায়ী কংগ্রেস পার্টির, ব্রিটিশ রাজের প্ররোচনায় এবং সার্বিক সহযোগিতায়। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা ও দমন করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ইউনিয়নকে অটুট রেখে স্বাধীনতার পর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের হিন্দু রাজন্যবর্গের বদান্যতা, সার্বিক সাহায্য সহযোগিতার সাথে ভারতবাসীকে বলির পাঁঠা বানানোর পুরস্কার স্বরূপ বর্ণহিন্দুদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো। ব্রিটিশদের এই চক্রান্তের কারণ ছিল মূলত দু’টি।

১। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উপমহাদেশ দখল করতে হয়েছিল মুসলমানদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে লড়াই করে। ফলে, শুরু থেকেই মুসলমানরা হয়ে ওঠে ইংরেজদের চক্ষুশূল। পক্ষান্তরে, প্রতিহিংসার রোষানলে বিদগ্ধ বর্ণহিন্দুরা ইংরেজদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো মুসলমান সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং বরণ করে নিয়েছিল মুসলমান শাসনের পরিবর্তে ইংরেজদের গোলামী।

২। ব্রিটিশ রাজ কায়েমের পর মুসলমানদের বিত্তহীন করে তাদের কাছ থেকে সমস্ত ধনসম্পদ, জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এভাবেই হিন্দুরা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাতারাতি বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আর মুসলমানদের পরিণত করা হয় নিঃস্ব, পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ে। সুদীর্ঘ দু’শ বছরের ইংরেজ গোলামির ইতিহাসের শেষদিন পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্রিটিশরা দেখেছে অনুগত আস্থাভাজন হিসাবে, আর মুসলমান সম্প্রদায়কে দেখেছে সন্দেহজনক বিদ্রোহী হিসাবে।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ধ্যান-ধারণায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট বর্ণ এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের আনুগত্য সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিল সুনিশ্চিত। তাই, তারা চেয়েছিল স্বাধীনতাত্তোর কালে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাতে হবে মুসলমানদের নয়-উচ্চবিত্তের হিন্দুদের, এতে পরোক্ষভাবে সম্ভব হবে তাদের কায়েমী স্বার্থ বাঁচিয়ে রাখা। এরই জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কংগ্রেসকে সর্বভারতীয় পার্টি হিসাবে গড়ে তোলার।

কংগ্রেস গড়ে তুলতে সুপরিকল্পিত ভাবে ধর্মীয় চেতনাকে সতর্কতার সাথে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো নব্য চাণক্যরা। ভারত মাতা, হিন্দুস্তান, বন্দেমাতরম ও জয়হিন্দ স্লোগান তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের আস্থা ও সমর্থন লাভে সফল হয়ে কংগ্রেসকে একমাত্র জাতীয় দল হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন গান্ধী এবং দলীয় নেতৃবৃন্দ।

ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কংগ্রেস যখন হিন্দুত্ববাদের নামাবলি গায়ে চড়াতে চাইলো সারা উপমহাদেশে তখন সব সংখ্যালঘু ভিন্নধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়।

মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের ঢাকা শহরেই জন্ম নিলো মুসলিমলীগ নামের রাজনৈতিক দল নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নৈতিক এবং দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাই ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। ক্রমান্বয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান এই দুই দাবিতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ভয়াবহ সংঘাতের রূপ ধারণ করে। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মতো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ত্যাগ ও তিতিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো বাংলাদেশের মুসলমানরাই। ইতিহাস তার সাক্ষী। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম শহীদ সংগ্রামী ছিল খুলনার কারমাইকেল কলেজের এক তরুণ ছাত্র। সেই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমার স্বর্গীয় পিতা আলহাজ শামসুল হক তখন সলিমুল্ল্যাহ মুসলিম হলের জেনারেল সেক্রেটারি একিসাথে মুসলিমলীগের ছাত্র এবং যুব সংগঠনের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা।

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ রাজ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। ‘ভারত মাতা’কে দ্বিখণ্ডিত করে ১৯৪৭ সালে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয় পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান (ভারত) নামে।

কালের স্রোতে রাজনৈতিক নেতৃবর্গের অদূরদর্শিতা, অপশাসন, শোষণ-বঞ্চনা এবং দেশি-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর চক্রান্তের ফলে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে।

অতএব, অখণ্ড ভারতের যৌক্তিকতা কতটুকু সেটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, যে সকল জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য রক্তের আহূতি দিতে প্রস্তুত তাদের চেতনাকে অস্ত্রের মাধ্যমে পরাস্ত করা কিছুতেই সম্ভব হয় না।

স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই সত্যকেই আরেকবার প্রমাণ করেছে। উপমহাদেশের চলমান স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়বর্তিকা হিসাবে বাংলাদেশ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

সাংবিধানিকভাবেও বিশ্ববাসীর যেকোনো স্বাধীনতার সংগ্রামে সমর্থন দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ। এটাই প্রতিবেশী ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ হুমকি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার চেতনার প্রতীক শিখা অনির্বাণকে কখনোই নেভাতে পারবে না কোনও আগ্রাসী অপশক্তি। লেখক সেটাই বিশ্বাস করে।