ঢাকায় চুরান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিক্রিয়া

ঢাকায় গিয়ে জিয়াকে আমাদের চূড়ান্ত যে সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে এসেছিলাম তাতে তার আঁতে ঘা লেগেছিল। তিনি সেটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার মুখোশ উন্মোচিত করে তার আসল চেহারাটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে পারে একমাত্র সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা বিদেশে অবস্থান করছে। এতে আতংকিত হয়ে তিনি তার কোর্সমেট তৎকালীন DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে হুকুম দিলেন আমার বিদেশের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে কর্মরত সহযোদ্ধাদের সাথে বৈঠক এবং ঢাকায় আসার পর বিভিন্ন মহলের আস্থাভাজন সুজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে আমাদের বিরুদ্ধে এমন একটা কেসের নাটক সাজাতে যাতে প্রমাণিত হয় বিদেশে অবস্থান করেও আমরা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছি। এই কেসের সুবাদে দেশের ভেতরে বেশ কয়েকজন সামরিক এবং বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা চার্জশিটে বন্দী করে জেলে ঢুকানো হল। কর্নেল নুরুন্নবী খান বীরবিক্রম ‘৭১ সালে জিয়ার সহযোদ্ধা, কর্নেল দিদারুল আলম বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন যুবনেতা মনির তাদের মধ্যে অন্যতম। মেজর খায়রুজ্জামান তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকায় তাকেও সাওয়াল-জবাবের সম্মুখীন হতে হয়। চাতুর্যের সাথে কর্নেল পাশাকে Consultation এর নামে দেশে ডেকে পাঠিয়ে কারাবন্দী করা হয়। চালানো হল তাদের উপর অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন স্বীকারোক্তি আদায় করার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে কর্নেল পাশার উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে তাকে রাজসাক্ষী বানাতে সক্ষম হয় DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। অন্যদের অমানবিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে কর্নেল পাশা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে বন্দী কর্নেল দিদার গোপনে পাশার নিকট অনুরোধ জানান পাশা যেন রাজসাক্ষী হয়ে তাদের অপরাধ নিজ কাঁধে তুলে নেন যাতে তাদের শাস্তির মাত্রা কিছুটা লঘু হয়। পরবর্তীতে পাশা স্বীকারোক্তিতে শুধু বলেছিলেন, সেনা পরিষদের নির্বাসিত নেতৃবর্গ দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করছিলেন। এর বেশি কিছু তার মুখ থেকে সরকার পক্ষ বের করতে পারেনি।

তার জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করেই কর্নেল নুরুন্নবী বীরবিক্রম এবং অন্য সবাইকে অভিযুক্ত করা হল বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে। দেশে ডেকে পাঠানো হল সব সহযোদ্ধা কূটনীতিকদের। আর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে গণচীনে পাঠানো হল যাতে তিনি চীনা নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় আমাকে চীন থেকে ধরে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি জিয়ার একটি আবেদন পত্রও বহন করে এনেছিলেন জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। পত্রে জেনারেল জিয়া আবেদন জানিয়েছিলেন যাতে চীনা কর্তৃপক্ষ আমাকে জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। চীনা কর্তৃপক্ষ তার সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। ফলে ব্যর্থমনোরথ হয়েই খালি হাতে দেশে ফিরে যেতে হয়েছিল জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে। এই ঘটনার পর আমি বেইজিং ত্যাগ করে লন্ডন চলে যাই। নূরও তাই করে। অন্যান্য সবাই চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে যার যার সুবিধা মতো বিভিন্ন দেশে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। এ ভাবেই আবার আমরা ছিন্নমূল হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি কখনোই।

জেনারেল এরশাদের পরামর্শে সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অহরহ রদবদল করা হতে থাকে। এতে করে জিয়ার পরিবর্তে নিজের অবস্থানকেই মজবুত করে নিতে সক্ষম হন চতুর আর্মি চীফ জেনারেল এরশাদ। জেনারেল জিয়ার সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে সেনাসদর থেকে অনেক PSO কে সরিয়ে দেয়া হয়। CGS জেনারেল মঞ্জুরকেও জিয়ার কাছ থেকে দূরে চট্টগ্রামে GOC করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই পোস্টিং এ জেনারেল মঞ্জুর ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন তার দিন ফুরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে, ভারত সরকার এবং RAW -এর চক্রান্তে চীন থেকে এক সফর শেষে মানবেন্দ্র লারমা দেশে ফিরে যাবার পর তাকে আগরতলায় সন্তু লারমার মাধ্যমে মারিয়ে সন্তু লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি পরিষদের প্রধান বানিয়ে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র ইন্সারজেন্সির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয় যাতে জেনারেল মঞ্জুরের ডিভিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব হয়।

মানবেন্দ্র লারমার চীন সফরকালে আমার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিলো। পুরনো বন্ধু মানবেন্দ্র লারমা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা একজন তরুণ নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা। আলোচনা কালে মানবেন্দ্র আমাকে বলেছিল, আগস্ট বিপ্লবের পর তার প্রত্যাশা ছিল বৈপ্লবিক সরকার শেখ মুজিবের নীতি বদলে পশ্চাদপদ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো মেনে নেবে। ফলে তারাও বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করবে। সে বলেছিল, ১৫ই আগস্টের পর দ্রুত ৩রা নভেম্বর এবং ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তনগুলো ঘটে যাওয়ায় সে আমার সাথে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা করতে পারেনি। কারণ, মুজিবের শাসন কালের পুরো সময়টাই তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়েছিলো। লারমা আমাকে অনুরোধ করেছিলো জেনারেল জিয়াকে তার পয়গামটা পৌঁছে দিতে যে সে এই বিষয়ে জিয়ার সাথে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। আমি তাকে বলেছিলাম, এখন জিয়ার সাথে আলাপ করে কোন লাভ হবে না। এরপরই দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা হয়।

মানবেন্দ্র লারমার দুঃখজনক মৃত্যুর পর সন্তু লারমার নেতৃত্বে ভারতের প্ররোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করার জন্য বেগবান করা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। জনসংহতি পরিষদের ইন্সারজেন্সির মোকাবেলা করার অজুহাতে জেনারেল নাসিমের পরামর্শে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী কমান্ড লেভেলের প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের কাকতালীয় ভাবে চট্টগ্রামে পোস্ট করা হতে থাকে। এই পদক্ষেপে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য সব কয়টি সেনানিবাসেই কমান্ড লেভেলে চীফ জেনারেল এরশাদের অনুগত পছন্দসই অফিসারদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি সহজ করে দেন তার অধিনস্ত MS জেনারেল নাসিম।
ষড়যন্ত্রের এই সমস্ত সূক্ষ্ম চালগুলো লক্ষ্য করার মতো সময় তখন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার ছিল না। কারণ, তখন তিনি বিশ্বনেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অধোগতি রোধ করার জন্য জিয়া তার বিশ্বস্ত জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে DGFI এর পদ থেকে সরিয়ে বানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জিয়ার এই সিদ্ধান্তের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে জেনারেল এরশাদ তার একান্ত বিশ্বস্ত এক জেনারেল মাহমুদকে নিয়োগ দিলেন DGFI হিসাবে। জিয়া যখন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন তখন দেশে তার বিরুদ্ধে খিচুড়ি পাকানো প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় হাই কমিশন, সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাস, RAW এবং KGB জেনারেল এরশাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী-বাকশালী এবং জাসদের নেতৃবৃন্দকে, সীমান্তের ওপারে অবস্থানকারী কাদের সিদ্দিকি এবং সন্তু লারমার সাথে। তাকে পরামর্শ দেয়া হল তিনি যাতে আটরশির পীর, হাফেজ্জি হুজুর, মাইজভাণ্ডারী, অন্ধ হাফেয, আমানী, বায়েতুল মোকাররমের খতিব প্রমুখদের সাথে বকধার্মিক সেজে তাদের সমর্থন আদায় করার স্বার্থে যেকোনো মূল্যেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এভাবেই জিয়ার বিশ্বস্ত নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে জিয়া বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে গাঁটছড়া বাঁধা জিয়ার অজান্তেই। সেনাবাহিনীর যাদের উপর নির্ভর করে এরশাদ জিয়া বিরোধী চক্রান্তের জাল বিছাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলঃ জেনারেল আব্দুর রহমান, জেনারেল চিশতী, জেনারেল মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার রফিক, জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল মীর শওকত, জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল আতিক, ব্রিগেডিয়ার নাসিম, ব্রিগেডিয়ার মিরন, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্‌, ব্রিগেডিয়ার আব্দুল হাফিজ, মেজর মনিরুল ইসলাম চৌধুরী, মেজর মোজাফফর, মেজর খালেদ, ক্যাপ্টেন এমদাদ, লেফটেন্যান্ট ইকবাল প্রমুখ। এদের সবাই তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। রাষ্ট্রপতির MS জেনারেল সাদেক চতুরতার সাথে জিয়াকে আশ্বস্ত করে চলেছিলেন। যার ফলে প্রেসিডেন্টের পক্ষে চক্রান্ত সম্পর্কে কিছুই অবগত হওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অন্যদিকে জেনারেল জিয়ার PS কর্নেল মাহফুজ, মঞ্জুরের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত থেকেও জিয়াকে কিছুই জানাচ্ছিলো না। লন্ডনে অবস্থান করায় আমার আর নূরের পক্ষে বিভিন্ন সূত্র থেকে সব খবরা-খবরই পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে খালেদা জিয়ার পছন্দের আর্মি চীফ জেনারেল নাসিম অস্থায়ী সরকারের প্রধান রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুথানের চেষ্টা চালায় যাকে খোলাখুলি ভাবে শেখ হাসিনা সমর্থন জানায়। পরে তাকে এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাকতালীয় ভাবে রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তকারী হিসাবে বিচার না করে জাতিকে হতবাক করে তাদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা দান করে সকল সুবিধাসহ চাকুরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।তারা এরপর থেকে বহাল তবিয়তেই রয়েছে, অথচ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং পৈশাচিক ভাবে জবাই করে হত্যা করা হয় ‘৭৫-এর সফল বিপ্লবের নেতা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা বীরকে যাদের দ্বারা একদলীয় স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক অধিকারের তোরণ খুলে দেয়া হয়। দেশবাসী আগস্ট বিপ্লবের সাফল্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন। তাই তারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সানন্দে গ্রহণ করে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের তারা মুক্তিদাতা এবং জাতীয় বীর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাদের খুলে দেয়া পথেই বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ দেশের অন্যসব কয়টি রাজনৈতিক দলের জন্ম এবং পুনর্জন্ম সম্ভব হয়। দেশের মানুষ ফিরে পায় ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন।

নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে, সুস্থ রাজনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বার্থে প্রচলিত সমঝোতার রাজনীতির অনৈতিকতা এবং আদর্শহীন জঘন্য কুটিলতা কতটা ক্ষতিকর। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর ২১শে বই মেলায় অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমার লেখা ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইটির ৮ টি সংস্করণ কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যাওয়াতে সরকার পক্ষের লোকেরা প্রথমে প্রকাশককে হুমকি দেয়, এই বইয়ের আর কোনও সংস্করণ ছাপানো চলবে না। তিনি তাদের হুমকির পরোয়া না করায় হাসিনা সরকার তাকে বন্দী করে এবং প্রেসটিকেও জ্বালিয়ে দেয়। ফলে বইটির আর কোনও সংস্করণ ছাপানো সম্ভব হয়নি। এরপরও গোপনে বইটির ইংরেজি এবং উর্দু অনুবাদ ছাপানো হয়। দুটো ওয়েবসাইট www.majordalim.com এবং www.majordalimbangla.com বন্ধ করে দেয় ইতিমধ্যে হাসিনা সরকার। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওয়েবসাইট দুটো আবার আপ লোড করা হয় www.majordalim.netwww.majordalimbangla.net নামে। সেই দু’টিও আবার বন্ধ করে দেয় হাসিনা সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে। রণেভঙ্গ না দিয়ে তৃতীয় বারের মতো সাইট দুটো www.majordalimbu.com এবং www.majordalimbubangla.com নামে বর্তমানে ওয়েব-এ রয়েছে। ২০০৮ সালে হাসিনা তার মুরুব্বীদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে সারাদেশে লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে তদানিন্তন সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদকে (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী অফিসার) সুযোগ করে দেয় বন্দুকের জোরে দেশে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জরুরী অবস্থা জারি করে ফখরুদ্দিনের সরকার কায়েম করতে। ফখরুদ্দিনের শ্যালক জনাব ইফতেখার চৌধুরী (বিএনপি পন্থী এনাম চৌধুরী এবং আওয়ামীলীগ পন্থী জনাব ফারুক চৌধুরীর ছোট ভাই) এই ক্ষমতা গ্রহণে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তখন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি SG বান কি মুনের অফিস থেকে জেনারেল মইনকে একটা ভুয়া পত্র যোগাড় করে দিয়েছিলেন যাতে লেখা ছিল বাংলাদেশের নৈরাজ্যিক অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিংবা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে কাউকে কোনও ‘Peace Making’ কিংবা ‘Peace keeping’ Mission এ নেয়া হবে না। এটা বর্তমানে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য টাকা রোজগারের একটি উত্তম পন্থা। সৈনিক থেকে অফিসার সবাই সিনিয়র অফিসারদের ঘুষ দিয়ে হলেও ঐ সমস্ত Mission এ গিয়ে ২ বছরের মধ্যে বিস্তর টাকার অধিকারী হয়ে ফিরে এসে আয়েশী জীবন কাটাতে সক্ষম হচ্ছেন। গরীব দেশগুলোর সামরিক বাহিনী যাকে বলা হয় ‘জাতির মেরুদণ্ড’ সেই প্রতিষ্ঠানের নৈতিক চরিত্র হরণের এটি এক অভিনব উপায়। জেনারেল মইন ঐ পত্রটি রাষ্ট্রপতিকে দেখিয়ে তাকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এই পত্রের ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিব্রত UN SG অফিস এক বিবৃতিতে ওই ধরনের কোনও পত্র ইস্যু করার বিষয়টি অস্বীকার করে। এই চক্রান্তের আর একজন নাটের গুরু ছিলেন জেনারেল মাসুদ চৌধুরী(অব) জনাব ফারুক চৌধুরীর আত্মীয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করা হয়নি কোনও তরফ থেকেই। জনাব ইফতেখার চৌধুরীও বহাল তবিয়তে ক্ষমতা উপভোগ করতে থাকেন নিজ পদে অধিষ্ঠিত থেকে।

আমার সুযোগ হয়েছিল জাতিসংঘের এইসব মিশনগুলোর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের। যুক্তির সাথেই বলা চলে এই সব মিশনগুলোর ফলে বিশ্বের কোনও দেশ কিংবা জাতির লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে নিও-ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক ভাবে এবং বিশ্বের সেরা ধনী কংগ্লোমারেটগুলো, রসদ সরবাহকারী সংস্থা এবং অস্ত্রসম্ভার নির্মাণকারিদের। তাছাড়া শক্তিধর দেশগুলো এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সব মিশন চলাকালে সক্ষম হয় যেকোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিধর প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় সদস্যদের বেছে নিতে যাতে করে প্রয়োজনে তাদের নিজস্ব গুঁটি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এরপর, পরিকল্পনা অনুযায়ী পাতানো নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী সিটে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয়। ভারতের তাবেদার জেনারেল এরশাদ এবারও আওয়ামী জোটে যোগদান করেন নিজের চামড়া বাঁচানোর দায়ে। সবচেয়ে হতবাক হবার বিষয় হল- মেনন, ইনু, রব, মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন, দিলিপ বড়ুয়ার মত ডাকসাইটে তথাকথিত এবং বাম নেতারাও আওয়ামী জোটে শরিক হয়ে হাসিনার নৌকায় চড়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে লজ্জাবোধ করলেন না! নীতি-বিবর্জিত দেশের রাজনীতিতে যেন সবকিছুই হালাল। যেমন ধড়িবাজ মওদুদ জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েও এখন আবার বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার একজন মুখ্য পরামর্শদাতা। কর্নেল অলি, বি. চৌধুরী, জমির উদ্দিন সরকারের মতো আরও অনেকেই নিজস্ব পার্টি বানিয়ে সুবিধে করতে না পেরে আবার ক্রমশ খালেদার কাছে ভিড়েছে। সত্যই বিচিত্র এই বাংলাদেশ! দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হয়েই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে হতোদ্যম এবং দুর্বল করে তোলার জন্য সর্বপ্রথম জরুরী ভিত্তিতে দুটো কাজ করে আওয়ামী জোট সরকার। বিডিয়ার হত্যাযজ্ঞ এবং আগস্ট বিপ্লবের ৫ জন বীরকে বিচারের প্রহসনের জবাহ এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা

এই জুডিশিয়াল মার্ডারের পর বিদেশের প্রায় সব প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান ওয়াচসহ মানবিক অধিকার সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠান এই ফাঁসির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এই দণ্ডকে ‘হাসিনার বেআইনি হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিমত প্রকাশ করে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক জোটের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য তো দূরের কথা, বরং তাদের বিবৃতির মাধ্যমে পরোক্ষ সমর্থন লাভ করতে পারায় হাসিনা সরকারের সাহস এবং প্রত্যয় যায়। বিডিআর এর ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয় ৫৭/৫৮ জন চৌকস সেনা অফিসার বিদেশ থেকে আনা ভাড়াটিয়া কমান্ডো বাহিনীর হাতে। লাঞ্ছিত হয়েছিলেন তাদের প্রিয় পরিবার পরিজনরা। তারই সূত্রে চাকুরিচ্যুত করা হয় শ’দুয়েক সেনা অফিসারকে যারা দেশবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে সেনাকুঞ্জে উষ্মার সাথে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ন্যায়বিচার দাবি করে তাকে ভীতসন্ত্রস্ত এবং বিব্রত অবস্থায় সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়ে এই দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে রহস্যজনক নীরবতা পালন করে নিশ্চুপ বসে তামাশা দেখলেন মাত্র। ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন খালেদার নেতৃত্বাধীন জোট। দেশের আইন শৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতির জন্য সেই সরকার একটা অভিযান চালিয়েছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়ে। অপারেশনটার নাম ছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’। খালেদার জোট সরকার এই ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’কে বৈধতা দেয়ার জন্য একটি ইনডেমনিটি এ্যাক্ট পাশ করেন দুইতৃতীয়াংশের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে সাংবিধানিক নীতি না মেনে দুই তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই ৫ম সংশোধনীর অঙ্গচ্ছেদ করে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর সংক্রান্ত ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি বাতিল করে সফল অভ্যুত্থানের নায়কদের বিরুদ্ধে সাধারণ হত্যা মামলা সাজিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিচারের প্রহসন শুরু করে তখন খালেদা জিয়ার বিরোধী জোট ১২০ টির অধিক আসন নিয়ে এর কোন প্রতিবাদ না জানিয়ে শুধুমাত্র সংসদ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিল মুখে কুলুপ এঁটে।এবার দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তার জোট সরকার অসংবিধানিক ভাবে বাতিল করা ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি কিন্তু পুনরায় বহাল করলো না। এভাবেই খালেদা জিয়ার জোট আওয়ামীলীগ সরকারের অসংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়ে জাতীয় বীরদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পথটি খোলাই রেখেছিলো। এটাকে সমঝোতার রাজনীতির একটি জ্বলন্ত নিদর্শন বললে কি ভুল বলা হবে? দেশ বিরোধী এই ধরনের ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ বসে থাকা সম্ভব হয়নি সেনাপরিষদের নেতৃবৃন্দের পক্ষে। কয়েকজন নেতা প্রবাসে ফেরারী হয়ে থাকা অবস্থাতেও তাদেরই উদ্যোগে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সর্বপ্রথম তথ্যবহুল একটি লিফলেট ‘জাগো দেশবাসী বাঁচাও বাংলাদেশ’ ও একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি সিডি দেশবাসী এবং বিদেশের মিডিয়া জগতে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ইমেইল করা হয় ৫ হাজারেরও বেশি অ্যাড্রেসে। বিডিআর চক্রান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠিও পাঠানো হয় তাকে জবাবদিহি করে। সেটার কপিও দেশবাসীর মধ্যে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করা হয়। কাজগুলো খুব বড় না হলেও সেই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্বটি গ্রহণ করা খুব একটা সহজ ছিল না। এর জন্য অনেক তরুণ-তরুণীকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঐসব দেশপ্রেমিকদের তাদের দুঃসাহসিকতা ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে শুধু লেখককেই নয়, দেশবাসীকেও। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যে সমস্ত তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সবাই বর্তমান প্রজন্মের। তাই যারা হতাশায় ভোগেন আর ভাবেন বর্তমান প্রজন্মের সবাই পচে গেছে তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

বর্তমান প্রজন্মের প্রতিজনের বিবেকে রয়েছে একটি স্ফুলিঙ্গ। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে পরীক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে জাতীয় স্বার্থে তারাও সৃষ্টি করতে পারে দাবানল। যার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিদেশী সুতোর টানে নেচে চলা নট-নটীরাও চলে যেতে পারে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এভাবেই একদিন সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি প্রতিশ্রুতিশীল নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যার ভিত্তি হবে ‘৭১ এর প্রকৃত চেতনা, স্বকীয় জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। সম্ভব হবে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠিত করা আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুষম রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে ঐতিহ্যবাহী, আত্মমর্যাদাশীল, সুখী সমৃদ্ধশালী এবং প্রগতিশীল একটি জাতি হিসাবে।